অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য যে গেল চ’লেবীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ’লে।যে-ভোরের তারা অরুণ-রবির উদয়-তোরণ-দোরেঘোষিল বিজয়-কিরণ-শঙ্খ-আবার প্রথম ভোরে,রবির ললাট চুম্বিল যার প্রথম রশ্মি-টীকা,বাদলের বায়ে নিভে গেল হায় দীপ্ত তাহারি শিখা!মধ্য গগনে স্তব্ধ নিশীথ, বিশ্ব চেতন-হারা,নিবিড় তিমির, আকাশ ভাঙিয়া ঝরিছে আকুল-ধারাগ্রহ শশী তারা কেউ জেগে নাই, নিভে গেছেসব বাতি,হাঁক দিয়া ফেরে ঝড়- তুফানের উতরোল মাতামাতি!হেন দুর্দিনে বেদনা-শিখার বিজলি-প্রদীপ জ্বেলেকাহারে খুঁজিতে কে তুমি নিশীথ-গগন-আঙনে এলে?বারে বারে তব দীপ নিভে যায়, জ্বালো তুমি বারে বারে,কাঁদন তোমার সে যেন বিশ্বপিতারে চাবুক মারে!কি ধন খুঁজিছ? কে তুমি সুনীল মেঘ-অবগন্ঠিতা?তুমি কি গো সেই সবুজ শিখার কবির দীপাম্বীতা?কি নেবে গো আর? ঐ নিয়ে যাও চিতার দু-মুঠো ছাই!ডাক দিয়ো না ক’, মূর্ছিতা মাতা ধুলায় পড়িয়া আছে,ডাক দিয়ো না ক’, শূন্য এ ঘর, নাই গো সে আর নাই,গঙ্গা-সলিলে ভাসিয়া গিয়াছে তাহার চিতার ছাই!আসিলে তড়িৎ-তাঞ্জামে কে গো নভোতলে তুমি সতী?সত্য-কবির সত্য জননী ছন্দ-সরত্বতী?ঝলসিয়া গেছে দু’চোখ মা তার তোরে নিশিদিন ডাকি’,বিদায়ের দিনে কন্ঠের তার গানটি গিয়াছে রাখি’সাত কোটি এই ভগ্ন কন্ঠে; অবশেষে অভিমানীভর-দুপুরেই খেলা ফেলে গেল কাঁদায়ে নিখিল প্রাণী!ডাকিছ কাহারে আকাশ-পানে ও ব্যাকুল দু’হাত তুলে?কোল মিলেছে মা, শ্মশান-চিতায় ঐ ভাগীরথী-কূলে!ভোরের তারা এ ভাবিয়া পথিক শুধায় সাঁঝের তারায়,কাল যে আছিল মধ্য গগনে আজি সে কোথায় হারায়?সাঁঝের তারা সে দিগন্তের কোলে ম্লান চোখে চায়,অস্ত-তোরণ-পার সে দেখায় কিরণের ইশারায়।মেঘ-তাঞ্জাম চলে কার আর যায় কেঁদে যায়দেয়া,পরপার-পারাপারে বাঁধা কার কেতকী-পাতার খেয়া?হুতাশিয়া ফেরে পূরবীর বায়ু হরিৎ-হুরীর দেশেজর্দা-পরীর কনক-কেশর কদম্ব-বন-শেষে!প্রলাপ প্রলাপ প্রলাপ করি সে আসিবে নাআর ফিরে,ক্রন্দন শুধু কাঁদিয়া ফিরিবে গঙ্গার তীরে তীরে!‘তুলির লিখন’ লেখা যে এখনো অরুণ-রক্ত-রাগে,ফুল্ল হাসিছে ‘ফুলের ফসল’ শ্যামার সবজি-বাগে,আজিও ‘তীর্থরেণু ও সলিলে’ ‘মণি-মঞ্জুষা’ ভরা,‘বেণু-বীণা’ আর ‘কুহু-কেকা’-রবে আজো শিহরায় ধরা,জ্বলিয়া উঠিল ‘ অভ্র-আবির’ ফাগুয়ায় ‘হোম শিখা’,-বহ্নি-বাসরে টিট্কারি দিয়ে হাসিল ‘হোমন্তিকা’-এত সব যার প্রাণ-উৎসব সেই আজ শুধু নাই,সত্য-প্রাণ সে রহিল অমর,মায়া যাহা হ’ল ছাই!ভুল যাহা ছিল ভেঙে গেল মহাশূন্যে মিলালো ফাঁকা,সৃজন-দিনের সত্য যে, সে-ই রয়ে গেল চির-আঁকা!উন্নতশির কালজয়ী মহাকাল হ’য়ে জোড়পাণিস্কন্ধে বিজয়-পতাকা তাহারি ফিরিবে আদেশ মানি!আপনারে সে যে ব্যাপিয়া রেখেছে আপন সৃষ্টি-মাঝে,খেয়ালী বিধির ডাক এল তাই চ’লে গেল আন্-কাজে।ওগো যুগে যুগে কবি, ও-মরণে মরেনি তোমার প্রাণ,কবির কন্ঠে প্রকাশ সত্য-সুন্দর ভগবান।ধরায় যে বাণী ধরা নাহি দিল, যে-গান রহিল বাকীআবার আসিবে পূর্ণ করিতে, সত্য সে নহে ফাঁকি!সব বুঝি ওগো, হারা-ভীতু মোরা তবু ভাবি শুধু ভাবি,হয়ত যা গেল চিরকাল তরে হারানু তাহার দাবি।তাই ভাবি,আজ যে শ্যামার শিস খঞ্জন-নর্তনথেমে গেল, তাহা মাতাইবে পুনৎ কোন্ নন্দন-বন!চোখে জল আসে, হে কবি-পাবক, হেন অসময়ে গেলেযখন এ-দেশে তোমারি মতন দরকার শত ছেলে।আষাঢ়-রবির তেজোপ্রদীপ্ত তুমি ধূমকেতু-জ্বালা,শিরে মণি-হার, কন্ঠে ত্রিশিরা ফণি-মনসার মালা,তড়িৎ-চাবুক করে ধরি’ তুমি আসিলে হে নির্ভীক,মরণ-শয়নে চমকি’ চাহিল বাঙালী নির্নিমিখ।বাঁশীতে তোমার বিষাণ-মন্দ্র রণরণি/ ওঠে জয়মানুষের জয়, বিশ্বে দেবতা দৈত্য সে বড় নয়!করোনি বরণ দাসত্ব তুমি আত্ম-অসম্মান,নোয়ায়নি মাথা, চির জাগ্রত ধ্রুব তব ভগবান,সত্য তোমার পর-পদানত হয়নি ক’ কভু, তাইবলদর্পীর দন্ড তোমায় স্পর্শিতে পারে নাই!যশ-লোভী এই অন্ধ ভন্ড সজ্ঞান ভীরু-দলেতুমিই একাকী রণ-দুন্দুভি বাজালে গভীররোলে।মেকীর বাজারে আমরণ তুমি র’য়ে গেলে কবি খাঁটি,মাটির এ-দেহ মাটি হ’ল, তব সত্য হ’ল না মাটি।আঘাত না খেলে জাগে না যে-দেশ, ছিলে সে-দেশের চালক,বাণীর আসরে তুমি একা ছিলে তূর্য-বাদক বালক।কে দিবে আঘাত? কে জাগাবে দেশ? কই সে সত্যপ্রাণ?আপনারে হেলা করি’ করি মোরা ভগবানে অপমান।বাঁশী ও বিষান নিয়ে গেছ, আছে ছেঁড়া ঢোলভাঙা কাঁসি,লোক-দেখানো এ আঁখির সলিলে লুকানো রয়েছে হাসি।যশের মানের ছিলে না কাঙাল, শেখোনি খাতির-দারী,উচ্চকে তুমি তুচ্ছ করোনি, হওনি রাজার দ্বারী!অত্যাচারকে বলনি ক’ দয়া, ব’লেছ অত্যাচার,গড় করোনি ক’ নিগড়ের পায়, ভয়েতে মানোনি হার।অচল অটল অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি তুমিউরিয়া ধন্য ক’রেছিলে এই ভীরুর জন্মভূমি।হে মহা-মৌনী, মরণেও তুমি মৌন মাধুরী পি’য়ানিয়েছ বিদায়, যাওনি মোদের ছল-করা গীতিনিয়া!তোমার প্রয়াণে উঠিল না কবি দেশে কল-কল্লোল,সুন্দর! শুধু জুড়িয়া বসিলে মাতা সারদার কাল।স্বর্গে বাদল মাদল বাজিল, বিজলী উঠিল মাতি’,দেব-কুমারীরা হানিল বৃষ্টি-প্রসূন সারাটি রাতি।কেহ নাহি জাগি’, অর্গল-দেওয়া সকল কুটীর-দ্বারেপুত্রহারার ক্রন্দন শুধু খুঁজিয়া ফিরিছে কারে!নিশীথ-শ্মশানে অভাগিনী এক শ্বেত-বাস পরিহিতা,ভাবিছে তাহারি সিঁদুর মুছিয়া কে জ্বালালো ঐ চিতা!ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দু’টি নারীস পানে?জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে!
Wednesday, 13 May 2015
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment